আযহার ওয়েলফেয়ার সোসাইটি বাংলাদেশ, মিশর (আওসবি)

কায়রোর মুসলিম সভ্যতায় সংক্ষিপ্ত সফর

আশরাফ মাহদি

উত্তর আফ্রিকার সর্ব বৃহৎ নগরী কায়রো। যার প্রচীন অলি-গলি থেকে নিয়ে উন্নত সড়ক-মহাসড়ক পর্যন্ত সবটা জুড়েই আছে ইতিহাসের সমৃদ্ধ সব অধ্যায়। প্রাচীন ফারাও সভ্যতা, গ্রিক সভ্যতা, রোমান সভ্যতা এবং সুদৃঢ় শেকড়গাথা মুসলিম সভ্যতার ইতিহাস ধারণ করে মহাকালের সাক্ষী হয়ে আছে এই নগরী। বিগত কয়েক শতাব্দীও কম ঘটনাবহুল ছিল না।

তাই এ শহরের গল্প যদি অল্প-বিস্তর বলতে বা শুনতে হয় তাতেও বেশ লম্বা সময়ের প্রয়োজন। তবুও অল্প সময়ে গুরুত্বপূর্ণ কিছু জায়গা ঘুরে দেখা যাক। আমি এ শহরের বাসিন্দা প্রায় পাঁচ বছর হতে চললো। আমার বাসার খুব কাছেই শারেউল মুইয। মুইয লি-দিনিল্লাহ সেই ব্যক্তি যার হাতে মিশরে ফাতেমি খেলাফতের সূচনা হয়েছিল। তার নামেই নামকরণ করা হয় সড়কটির। প্রাচীন এই সড়ক ঘিরে গড়ে উঠেছে ফাতেমি খেলাফতের দূর্গ। এর এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে যাওয়ার পথে বেশ কিছু ঐতিহাসিক স্থাপনা দেখা যায়। যার মধ্যে আছে খান আল-খলিলি।

মামলুকদের আমল থেকে আজ পর্যন্ত যা মিশরের সবচেয়ে জমজমাট বাজার। বর্তমান মিশরের সবচেয়ে বড় স্বর্ণ ও রূপা ক্রয়-বিক্রয়কেন্দ্র। দূর্গের গেটে ঢুকতেই প্রথমে নজররে পড়বে মসজিদে হাকিম বি-আমরিল্লাহ। কেল্লার দেয়ালের সাথে মিল রেখে যার ভিত্তিপ্রস্তর রাখা হয়েছে। হাকিম ছিলেন ফাতেমি খেলাফতের ৬ষ্ঠ খলিফা। যিনি একই সাথে ইসমাইলি শিয়াদের বড় ইমাম ছিলেন। শারেউল মুইযের শেষ মাথায় এসে দেখা মিলবে মসজিদে হুসাইনের। ফাতেমি শিয়াদের আমলে এই মসজিদকে ঘিরেও নানা শিরক বিদাতের আখড়া জমে উঠেছিল। দাবি করা হত এখানেই আছে হুসাইন রা. এর শির মুবারক।

ফাতেমি খেলাফতের দুর্গের বেশ কয়েকটি ফটক এখনও বহাল তবিয়তে আছে। শারেউল মুইযের অপর প্রান্তে বের হলেই চোখে পড়বে আল-আযহার মসজিদ। মূলত এই মসজিদকে ঘিরেই শুরু হয়েছিল আযহারের প্রাচীন শিক্ষাক্রম। এই মসজিদ প্রাঙ্গনে একসময়ে দরস দিয়েছেন ইমাম ইবনু হাজার আল-আসকালানি, ইমাম বদরুদ্দিন আল-আইনি, ইমাম জালালুদ্দিন আস-সুয়ুতি, ইমাম আব্দুর রহমান ইবনু খালদুন ও তকিউদ্দিন আহমদ আল-মাকরিজির মত ইসলামি জ্ঞান-বিজ্ঞানের মহা মনীষীরা।(সূত্র: আল-আযহার ফি আলফি আম, খ-১, পৃষ্ঠা : ১০২)

আমাদের বাংলা সাহিত্যের বরেণ্য ব্যক্তিত্ব সৈয়দ মুজতাবা আলীও আল-আযহারের ছাত্র ছিলেন। আল-আযহার মসজিদ থেকে বের হয়ে হাতের ডানে একটু হাটলেই দেখা যাবে আল-আযহার বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাচীন ক্যাম্পাসটি। মসজিদ থেকে এখানেই প্রথমবার ক্যাম্পাস স্থানান্তর করা হয়েছিল। এরপর ১৯৬০ সালে ইসলামিক ফ্যাকাল্টির পাশাপাশি অন্যান্য ফ্যাকাল্টির সূচনার মাধ্যমে পরিপূর্ণভাবে আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয় কারিকুলামে যুক্ত হয় আল-আযহার বিশ্ববিদ্যালয়। মুসলিম বিশ্বের পাশাপাশি এক সময় পুরো বিশ্বব্যাপী আযহার জনপ্রিয় হয়ে উঠতে শুরু করে। ধর্মীয় ও আধুনিক শিক্ষার সমন্বয়ে পরিপূর্ণ শিক্ষাব্যবস্থা প্রণয়নে আদর্শ কারিকুলাম উপহার দেয়। আযহারকে এই পরিসরে নিয়ে যাওয়ার পেছনে মিশরবাসীদের অবদানই সবচেয়ে বেশি। বিগত এক শতাব্দি ধরে শাইখুল আযহারের দায়িত্বে মিশরের যেসব মনীষীরা এসেছেন তাদের অবদান স্বর্ণাক্ষরে লিখে রাখার মত।

আযহার বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাচীন ক্যাম্পাসটির অবস্থানন ওল্ড কায়রোতে। যা ইসলামিক কায়রো বলে পরিচিত। মুসলমানরা মিশর বিজয় করতে এসে এই এলাকায় তাবু গেড়েছিল বলে এই নগরীর আরেক নাম ফুসতাত। বলা যায় এটাই আদি ও আসল কায়রো। ইসলামি ঐতিহ্যবাহী স্থাপনাগুলো প্রায় সবই ফুসতাত নগরীকে ঘিরে।আযহার থেকে অদূরেই সালাউদ্দিন আইউবির কেল্লা। কেল্লাটি নির্মাণ করা হয়েছে পাহাড়ের উপর। আমরা আযহার ক্যাম্পাসে যাওয়ার পথে এই কেল্লা দেখা যায়। মিশর থেকে ফাতেমিদের অন্ধকার দূর করার পেছনে ছিলেন কেল্লার নির্মাতা বীর আইউবি। তার হাত ধরেই নতুন সূর্যোদয় দেখেছিল এই নগরীর মুসলিমরা।

ঐতিহাসিক দিক থেকে ইসলামিক কায়রোর সবচেয়ে পুরাতন ও সমৃদ্ধ স্থাপনাটি হচ্ছ মসজিদে আমর ইবনুল আস। খলিফা ওমর ইবনুল খাত্তাব রা. এর নির্দেশে মিশর অভিযানে এসেছিলেন সেনাপতি আমর ইবনুস আস রা.। তিনি তখন ফুসতাত নগরীতে মসজিদটি নির্মাণ করেন। এর ধারাবাহিকতায় এসেছে আব্বাসিদের আমলে মসজিদে ইবনে তুলুন, মামলুকদের আমলে মসজিদে সুলতান হাসান, মসজিদে যাহির বাইবার্স। সবগুলো মসজিদই কায়রোর ইসলামি সভ্যতার সমৃদ্ধ নিদর্শন হিসেবে স্বমহিমায় দাঁড়িয়ে আছে। ইসলামিক কায়রোর ইতিহাস এক নজওে দেখতে চাইলে মাতহাফে ইসলামি (ইসলামি জাদুঘর) ঘুরে দেখার বিকল্প নেই। ইসলামি খেলাফতের ইতিহাস মিশর যতটুকু ধারণ করেছে তা সংক্ষিপ্ত পরিসরে বেশ গোছালোভাবে তুলে রাখা হয়েছে এই জাদুঘরে। মুসলিম শাসনামলের মুদ্রা, অস্ত্র, ব্যবহারিক সামগ্রিসহ নানা নিদর্শন সংরক্ষিত আছে সেখানে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *