আফছার হোসাইন
নীলনদ আর ফারাওদের দেশ মিশরে পবিত্র ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহার পরই সর্বোচ্চ ধর্মীয় এবং জাতীয় উৎসব ঈদে মিলাদুন্নবী। মিষ্টি ভোজনপ্রিয় মিশরীয়রা দিনটিকে মোলিদ আল নাবী বা মোলিদ আল রাসুল (সাঃ) নামেই ডাকেন।
প্রতি বছর আরবি মাস রবিউল আওয়াল শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে রাজধানী কায়রোসহ সারাদেশের সুপারশপ থেকে শুরু করে পাড়া মহল্লার অলিগলিতে হালোয়েত আল-মোলিদ নামের মিষ্টির দোকানের পসরা সাজিয়ে বসেন। সাধারণত বিভিন্ন ধরনের বাদাম ও চিনির ঘন সিরার মিশ্রণে তৈরি করা হয় এই মিষ্টি। তার মধ্যে ‘মালবান’ নামে মিষ্টি খুবই জনপ্রিয়।
মিশরের অদ্ভুত এক ঐতিহ্য ‘আরুসাত আল- মোলিদ’ (জন্ম দিনের পুতুল), চিনি দিয়ে তৈরি এই পুতুলগুলোকে সাদা ও রঙিন কাপড় দিয়ে নববধূ পোশাকের সাজে সজ্জিত করে বিক্রি করা হয়, যা এদেশের শিশুদের কাছে অত্যন্ত প্রিয়।
মিশরে প্রথম মিলাদুন্নবী উদযাপনের প্রচলন শুরু হয় ফাতিমীয় খেলাফত (১০ থেকে ১২ শতক) যুগের সময় থেকে।
জানা যায়, তৎকালীন শাসকগোষ্ঠী দরিদ্র ও অভাবী মানুষের জন্য বড় বড় ভোজনের আয়োজন করত এবং প্রচুর পরিমাণে হালাওয়েত আল-মোলিদ (মিষ্টি) বিতরণ করত।
কথায় আছে, ষষ্ঠ ফাতেমীয় খলিফা আল-হাকিম আল-আমর, মোলিদ আল-নাবী উপলক্ষে তার স্ত্রীদের একজনকে নিয়ে শহরে ঘুরতে বের হয়েছিলেন, যখন তিনি মুকুট পরে গাড়িতে জনসাধারণের সামনে হাজির হন, তখন লোকেরা তাকে দেখে এতটাই মুগ্ধ হয়েছিল যে তার সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে একজন মিষ্টির কারিগর নববধূর আকারে একটি মিষ্টির পুতুল তৈরি করে খলিফাকে উপহার দিয়েছিলেন। সেই থেকেই এ দেশে আরুসাত আল-মোলিদ প্রচলন শুরু হয়। বেশিরভাগ মিশরীয়ই মনে করেন এর সঙ্গে ধর্মীয় কোনো সম্পর্ক নেই।
আগেই বলছি, এটি মিশরের একটি জাতীয় দিবস। সরকারি ছুটির এদিনে এখানে সম্মিলিত বাহিনীর কুচকাওয়াজ হয়। আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ে এক অনাড়ম্বর অনুষ্ঠানে মিশরীয় রাষ্ট্রপতি এবং আল আজহারের গ্র্যান্ড ইমাম দেশের গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ উপযুক্ত ব্যক্তিদের হাতে তুলে দেন জাতীয় পদক। আল-আজহার ও ঈমাম হোসাইন (র.) মসজিদসহ গুরুত্বপূর্ণ মসজিদের মিলাদুন্নবীর মাহফিল স্থানীয় টিভি চ্যানেলগুলোর মাধ্যমে সরাসরি সম্প্রচার করা হয়।
এদেশে ঈদে মিলাদুন্নবী উপলক্ষে ১২ রবিউল আওয়ালের দুই তিনদিন আগে থেকেই মিশরজুড়ে চলে মিষ্টি বিতরণ। স্কুল কলেজের ছাত্রছাত্রী থেকে শুরু করে সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মচারীদের হালাওয়েত আল-মোলিদ মিষ্টি বিতরণ করা হয়, নিজ নিজ প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে। পাড়া প্রতিবেশীরাও একজন আরেকজনকে মিষ্টি উপহার দেন।
১২ রবিউল আওয়াল বা মিলাদুন্নবীর দিনে অনেক মিশরীয় রোজা রাখেন ও অতিরিক্ত সময় ধরে পবিত্র কোরআন তেলোওয়াত ও সুন্নত নামাজ আদায় করেন। তবে কোনো মসজিদ বা অন্য কোথাও দাঁড়িয়ে মিলাদ কায়েম করতে দেখা যায় না। এদিন সন্ধ্যার পর অনেক মিশরীয় পরিবারকে দেখা যায়, ঘরে রুজ-বি-লাবান (দুধ পায়েস) তৈরি করে ছোট ছোট পাত্রে রাস্তায় মানুষের মধ্যে বিতরণ করতে।
তবে শুধু এই নববধূর পুতুলের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয় বরং আরও বিভিন্ন মিষ্টির পুতুল যেমন ঘোড় সওয়ারি, মসজিদ মিনারসহ মুসলিম সংস্কৃতির সঙ্গে যায় এমন অনেক আয়োজন মিশরবাসী করে থাকেন। এসব আয়োজন মূলত-জাতীয়ভাবে মুসলিম পরিবারে ও সমাজের পরের প্রজন্ম বাচ্চাদের কাছে মানবতার শ্রেষ্ঠতম রহমত দয়াল নবীজীকে অত্যন্ত আনন্দের সাথে পরিচয় করিয়ে দেওয়ায় এর অন্যতম উদ্দেশ্য।
রাসূলের প্রতি ভালোবাসার সুদূরপ্রসারী সাংস্কৃতিক দাওয়াত। এর ভালো প্রভাব পরে বড় হলে অত্যন্ত গভীরভাবে পরিলক্ষিত হয়, যেমন দুজনের মাঝে যে কোনো বড় ঝগড়া-বিবাদ থেমে যায় শুধু ‘সাল্লি আলান্নাবী’ বাক্যটি বললেই।