মুহা. ইয়াছিন আরাফাত
আজ থেকে প্রায় ৭৩ বছর পূর্বেও বিশ্ব মানচিত্রে ইসরায়েল বলে কোন দেশের অস্তিত্ব ছিল না৷ ১৯৪৮ সালে প্রকাশিত বিশ্ব মানচিত্রে জর্ডান নদের পশ্চিম পাড়ে অবস্থিত অঞ্চলকে ফিলিস্তিন নামে চিহ্নিত করা হয়েছিল। এরপর ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ঘোষণার সাথে সাথেই মধ্য প্রাচ্যের এই ভূখণ্ডটির মানচিত্র, ইতিহাস ও জনসংখ্যার বিন্যাসে আমূল পরিবর্তন হতে শুরু করে।
১৯৪৭ সালের পূর্বে ফিলিস্তিন:
উনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে জায়নবাদ আন্দোলনের সূচনা হলে ইউরোপ থেকে ফিলিস্তিন অভিমূখে ইহুদি শরণার্থীদের ঢল শুরু হয়। সর্বশেষ লেভান্ট অঞ্চলে উসমানী খিলাফতের পতন ও বৃটিশ ম্যান্ডেট কতৃক ১৯১৭ সালের বেলফোর চুক্তি (ফিলিস্তিন ভূখণ্ড ইহুদি জাতি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি) বাস্তবায়নের উদ্যোগ হাতে নিলে ফিলিস্তিনের উত্তর ও উপকূলীয় অঞ্চলে ব্যাপকভাবে নতুন ইহুদি বসতি গড়ে উঠতে শুরু করে।
দ্বিজাতি রাষ্ট্রের প্রস্তাবনা ও আরব জনতার প্রত্যাখ্যান:
গত শতাব্দীর মধ্য ভাগে ইউরোপে ইহুদি বিদ্বেষী নাৎসিবাদের উত্থান হলে ইউরোপ থেকে ইহুদি শরণার্থীদের ঢল ও ফিলিস্তিনি আরব জাতীয়তাবাদের উত্থানের ফলে আরব ও ইহুদিদের মধ্যে উত্তেজনা স্পষ্ট হতে শুরু করে এবং প্রায়শই ক্রমবর্ধমান সহিংসতা ও ঘটনাপ্রবাহ ১৯৩৬ সালের ফিলিস্তিনি মহান বিপ্লবের পথ প্রশস্ত করে দেয়।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে বৃটিশরাজ ফিলিস্তিন সংকট সমাধানের ভার জাতিসংঘের উপর ন্যস্ত করে। পরবর্তীতে ১৯৪৭ সালে বৃটেন পবিত্র কুদস ও বাইতুল-লাহম (বেথেলহাম) শহরকে আন্তর্জাতিক প্রশাসনের হাতে ন্যস্ত করে ফিলিস্তিনের বাকি অংশকে দুভাগে বিভক্ত করে আরব ও ইহুদিদের জন্যে আলাদা দুটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব করে। এই প্রস্তাবকে ইহুদি নেতারা স্বাগত জানালেও আরব নেতৃবৃন্দ ও সাধারণ জনগণ অত্যন্ত ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করে।
১৯৪৮ সালের ১৪ মে মাসে লেভান্ট এলাকায় ব্রিটিশ ম্যান্ডেটের অবসানের প্রাক্কালে ফিলিস্তিন ভূখণ্ডে ইহুদি নেতৃত্ব ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দিয়ে নিরস্ত্র আরবদের গণহত্যা ও আদিবাসী ফিলিস্তিনিদের বাস্তুচ্যুত করে তাদের ভিটেমাটি ও সহায়-সম্পত্তি জবরদখল করে নেয়।
১৯৪৮ সালে বৃটিশ ছত্রছায়ায় অবৈধ ইসরায়েল রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠার প্রতিক্রিয়া স্বরূপ মিশর, সিরিয়া, জর্ডান ও ইরাকের সম্মিলিত সামরিক বাহিনী ফিলিস্তিনের স্বাধীনতার লক্ষ্যে দখলদার ইসরায়েলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। পরবর্তীতে ১৯৪৯ সালে দেশগুলোর সাথে যুদ্ধবিরতি চুক্তি স্বাক্ষরিত হলে ইসরায়েল মিশরীয় নিয়ন্ত্রণাধীন গাজা উপত্যকা ব্যাতিত সমগ্র নাগাব, জাজিল, উত্তর ফিলিস্তিন ও উপকূলীয় অঞ্চলে নিজদের পুর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে। পূর্ব কুদস ও পশ্চিম তীরের নিয়ন্ত্রণ ভার গ্রহণ করে জর্ডান কর্তৃপক্ষ। যুদ্ধবিরতি হলেও আরব দেশগুলো অবৈধ ইসরায়েল রাষ্ট্রের বৈধতার আইনি স্বীকৃতি দেয়নি।
১৯৬৭ সালের আরব-ইসরায়েল যুদ্ধ:
১৯৬৭ সালের ঐতিহাসিক ৬ দিনের যুদ্ধে আরব দেশগুলোর পরাজয়ের পর ফিলিস্তিনের মানচিত্রে ব্যাপক পরিবর্তন ঘটে। সেই যুদ্ধে ইসরায়েল মিশরের সিনাই উপত্যকা, গাজা স্ট্রীপ, পশ্চিম তীর ও পূর্ব কুদসসহ সিরিয়ান গোলান মালভূমির সিংহভাগ এলাকা দখল করে নেয়। ফলশ্রুতিতে ইসরায়েলের মানচিত্র প্রায় তিনগুণ বৃদ্ধি পায়। তবে আন্তর্জাতিক মহল ইহুদিদের এহেন আগ্রাসী আচরণ প্রত্যাখ্যান করে এবং এখন পর্যন্ত উক্ত এলাকাগুলো দখলকৃত ভূমি হিসেবে বিবেচনা করে আসছে।
সর্বশেষ ২০১৮ সালে ট্রাম্প ক্ষমতায় আসলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার পূর্বের অবস্থান পরিবর্তন করে জেরুজালেমকে ইসরায়েলের রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে সেখানে নিজেদের দূতাবাস সরিয়ে নেয়। তবে যুক্তরাষ্ট্র ও হাতে গোনা কয়েকটি দেশ ছাড়া জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এখনো জেরুজালেম ও গোলান মালভূমিকে দখলীকৃত এলাকা হিসেবে বিবেচনা করে থাকে।
১৯৭৯ সালে মিশর ও ইসরায়েলের পরস্পরের সীমানা নির্ধারণের মাধ্যমে শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এবং চুক্তি অনুযায়ী ১৯৮২ সালে ইসরায়েল কর্তৃপক্ষ সিনাই উপত্যকা থেকে তাদের সামরিক ও বেসামরিক কার্যক্রম গুটিয়ে নিলে প্রতিদান স্বরূপ প্রথম আরব রাষ্ট্র হিসেবে মিশরের স্বীকৃতি লাভ করে। তবে গাজা স্ট্রীপ, পূর্ব তীর ও গোলান মালভূমি ১৯৪৯ সালের যুদ্ধবিরতি চুক্তি অনুযায়ী তাদের নিয়ন্ত্রণেই থেকে যায়। অবশ্য সেগুলো নিয়ে মিশরের তেমন মাথা ব্যথাও ছিল না।
মিশরের স্বীকৃতি লাভের এক দশকেরও বেশি সময় পরে ১৯৯৪ সালে জর্ডান-ইসরায়েল ‘ওয়াদি আরাবা শান্তি চুক্তি’র মাধ্যমে তারা বৈধ রাষ্ট্র হিসেবে জর্ডানের স্বীকৃতি লাভ৷ এবং উভয় দেশ একে অপরের সীমানা স্বীকার করে নেয়।
২০০৫ সালে ইসরায়েল গাজা স্ট্রীপ থেকে সৈন্য প্রত্যাহার করে নিলে এবং গাজা ও ইসরায়েলের সীমানা চূড়ান্ত হলেও জাতিসংঘ পশ্চিম তীর ও গাজা উপত্যকাকে অবরুদ্ধ অঞ্চল হিসেবে বিবেচনা করে থাকে।
ইউরো নিউজ আরবি থেকে অনূদিত