জুবায়ের আহমাদ
বীর সিপাহসালার সুলতান সালাহ উদ্দিন আইয়ুবি ১১৮৭ সালের অক্টোবরে বাইতুল মুকাদ্দাস বিজয় করেছিলেন। ২০২৩ সালের অক্টোবরেও কি সেই বিজয়ী আক্রমণগুলো শুরু করেছে হামাস?
ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ যোদ্ধারা গাজা স্ট্রিপের বসতিগুলো থেকে যে মারমুখী আক্রমণ শুরু করেছে, ইসরায়েলি দখলদার সেনাবাহিনী কখনো এর কল্পনাও করতে পারেনি হয়ত। এর আগে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে যত যুদ্ধ এবং আক্রমণ করা হয়েছে, সেসবের তুলনায় এটির কার্যকারিতা ছিল অনেক বেশি। আরব-ইসরায়েল এবং ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘাতের ইতিহাসে একেই ক্ষয়ক্ষতির দিক থেকে সবচে কার্যকর এবং যথার্থ একটি আক্রমণ বলে বিবেচনা করা হচ্ছে।
ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ আন্দোলনের সামরিক শাখা হামাসের ইযযুদ্দিন আল কাসসাম ব্রিগেড এই সাহসী অভিযান পরিচালনার মাধ্যমে দখলদার জনগোষ্ঠী ও সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বকে শুধু বিস্মিতই করেনি বরং এক প্রকার ত্রাসও সৃষ্টি করেছে। হামাস এই অপারেশনটির নাম দিয়েছে ‘তুফান আল আকসা’ বা আল আকসার ঝড়! ইযযুদ্দিন আল কাসসাম ব্রিগেডের ঝড়ের বেগে পরিচালিত এই অভিযান ইঙ্গিত করছে যে— এখন সময়টা আর আগের মতো নেই। ময়দানের যুদ্ধনীতিতে পরিবর্তন এসেছে। পরিবর্তন এসেছে অপারেশন পরিচালনায়ও। ফিলিস্তিনের বিপ্লবী জনগণ এখন নিজেদের অস্তিত্বের জানান দিচ্ছে নানাভাবে নানা কৌশলে। কখনো শক্তি এবং সক্ষমতাকে যথাযথভাবে কাজে লাগিয়ে ইসরায়েলি আক্রমণগুলো চূড়ান্তভাবে প্রতিরোধ করে, বিভিন্ন শহর এবং সীমান্তে একের পর এক সফল অভিযান পরিচালনা করে। কখনো ইসরায়েলের ভিতরে ঢুকে অফিস ও আদালাত ও বেন গুরিয়নের মতো আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর অচল করে দেওয়ার মাধ্যমে। এতে জায়নবাদীদের কলিজায় ভীতির সঞ্চার করে পঞ্চাশটি বছর ধরে পড়ে পড়ে মার খাওয়া মুক্তিকামী ফিলিস্তিনিরা জানিয়ে দিচ্ছে— দখল করে কোন জাতিকে দমিয়ে রাখা যায় না। কারণ, লোহা আগুনের তাপে শুধু ধারালোই হতে থাকে!
১৬ বছরেরও বেশি সময় ধরে গাজায় অব্যাহত অবরোধ ঠেকাতে, বাইতুল মাকদিস পুনরুদ্ধার, কারাবন্দী বিপ্লবীদের মুক্তি, পশ্চিম তীরের শহরগুলোতে ক্রমাগত অনুপ্রবেশ এবং ইসরায়েলের জুলুম, লুন্ঠন ও দখলদারির প্রতিক্রিয়া হিসেবে গত শনিবার ৭ই অক্টোবর ২০২৩ সকালের দিকে হামাস উক্ত অপারেশনটি পরিচালনা করে। মাত্র ১০০ ডলারেরও কম খরচে তৈরী রকেট লাঞ্চারগুলো যেভাবে মিলিয়ন ডলারের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে তুলোধুনো করছে, সেটা ইসরায়েল এবং বিশ্ববাসীর কাছে নতুন হলেও ফিলিস্তিনি বিপ্লবীদের কাছে নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। বিশেষ করে ‘ইযযুদ্দিন আল-কাসসাম ব্রিগেড’ এর কাছে তো একদমই পানিভাত৷
দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে এতটা সফল এবং ভয়ানক আক্রমণ থেকে যে শিক্ষা ইসরায়েল পেয়েছে, কখনোই সেটি তারা ভুলতে পারবে না। তাদের প্রভাব-প্রতিপত্তি ধুলোয় মিশে গেছে। অনেকেরই ধারণা, এই হামলার পেছনে খোদ নেতানিয়াহুর হাত রয়েছে। কারণ, এত শক্তিশালি প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা, অত্যাধুনিক সব সমরাস্ত্র, উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহার থাকার পরেও কীভাবে এতটা তীব্র আক্রমণ করা সম্ভব!
হামাসের এই কার্যকর অভিযান আবারও এটাই প্রমাণ করে যে, ফিলিস্তিনি জনগণের জন্য দখলদার ইহুদিবাদের মোকাবিলায় তীব্র প্রতিরোধ ও অটল-অবিচল থাকার বিকল্প কিছু নেই। ষড়যন্ত্রকারীরা যতই ষড়যন্ত্র করুক, হেকমতের নামে যতই আত্মসমর্পণ করুক না কেন, ফিলিস্তিনিদের দমিয়ে রাখা কোনো অবস্থাতেই সম্ভব নয়। ওসলো চুক্তির দোহাই দিয়ে, ইহুদিবাদী শত্রুর সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করারও আর কোন সুযোগ নেই। যেটা আরেক ফিলিস্তিনি সশস্ত্র সংগঠন ‘ফাতাহ’ করে যাচ্ছে। কথিত আছে, ইসরায়েলি ডোনেশন পেয়ে একসময়কার জনপ্রিয় সংগঠন ‘ফাতাহ’ শান্তিচুক্তির নামে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার প্রয়াস চালিয়ে গেছে, যা কখনোই ফিলিস্তিনি বিপ্লবী জনগণ মেনে নেয়নি। কারণ তারা জানে, আজ আক্রমণ করলে কাল হয়তো বিজয় আসবে না, কিন্তু কাল আক্রমণ না করলে পরদিন পরাজয় সুনিশ্চিতভাবেই আসবে।
তাই এই যুদ্ধটা দখলদার ইহুদিদের বিরুদ্ধে শুধু স্বাধীনতাকামী বীর বিপ্লবী ফিলিস্তিনি জনগণেরই নয়, বরং সমগ্র মুসলিম জাতির। সেজন্য দখলদার ইহুদিদের মজবুত হাতে দমিয়ে রাখতে, ফিলিস্তিনিদের মুক্তির এবং তাদের পূর্ণ অধিকার পুনরুদ্ধার করতে প্রতিরোধ সংগ্রামের মাত্রা কেবলই বাড়াতে হবে।
হামাসের সামরিক শাখা ‘ইযযুদ্দিন আল-কাসসাম ব্রিগেড’ গাজায় যেভাবে অত্যন্ত নিখুঁত এবং দক্ষতার সাথে অপারেশন পরিচালনা করছে, ঠিক সেভাবেই মিডিয়া কভারেজ ও প্রচারণায়র ক্ষেত্রেও সৃজনশীলতা এবং শ্রেষ্ঠত্বের পরিচয় দিচ্ছে। মুসলিম বিশ্ব তাদের সমর্থন করে যাচ্ছে। বাইতুল মাকদিস বিজয়ের এই মাসে ফিলিস্তিনের প্রতিটা জনগণ বুঝে গেছে, প্রতিরোধ-আক্রমণই তাদের একমাত্র উপায় এবং মুক্তির একমাত্র অবলম্বন৷