আযহার ওয়েলফেয়ার সোসাইটি বাংলাদেশ, মিশর (আওসবি)

আমরা ফিলিস্তিনের পক্ষে

আবদুল্লাহ হাশেম

গত কয়েকদিন ধরে ফিলিস্তিনের পক্ষে আরব ও মুসলিম দেশগুলোসহ বিশ্বব্যাপী লক্ষ লক্ষ মানুষ বিক্ষোভ ফেটে পড়েছে। আমেরিকা, বৃটেন, ফ্রান্স ও জার্মানিতেও বিক্ষোভের চিত্র দেখা গেছে। যেখানে তারা গাজায় হামাসের নেতৃত্বে ফিলিস্তিনিদের লড়াইয়ের প্রতি সংহতি প্রকাশ করেছেন এবং ইসরায়েলি সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে তীব্র নিন্দা জানিয়েছেন, নৃশংসতায় যা মানবেতিহাসের পূর্বের অনেক যুদ্ধকে ছাড়িয়ে গেছে।
প্রতিবাদী মিছিলগুলো সড়ক মহাসড়ক ছাপিয়ে রূপ নিয়েছে জনসমুদ্রে। মানুষের বুক থেকে নির্গত হচ্ছে ক্ষোভের অগ্নি লাভা। বর্বর জায়োনিস্টদের নিষ্ঠুরতা থেকে যে রক্ষা পায়নি ঘরবাড়ি, বাজার, স্কুল এমনকি হাসপাতালও! বিমান হামলায় শহীদদের অধিকাংশই নারী, শিশু, বৃদ্ধ ও নিরপরাধ বেসামরিক নাগরিক। দেশ থেকে মহাদেশে প্রতিবাদীদের গর্জনে, সমস্বরে উচ্চকিত হচ্ছে একটি শ্লোগান- আমরা সবাই হামাসের সাথে।

১৯২০ এর দশকে বৃটেন এবং পশ্চিমাদের একাট্টা সহযোগিতায় ফিলিস্তিনের ভূমিতে জায়নবাদিদের অনুপ্রবেশের পর আশি বছর পেরিয়ে গেলো, ১৯৪৮ সালে ফিলিস্তিনিদেরকে আপন ভূমি থেকে উৎখাতের নাকবা সংঘটিত হলো, প্রত্যাবর্তন সম্ভব হয়নি আজো।
ইহুদীবাদিদের বর্বরতার বিরুদ্ধে আমরা সবাই হামাসের সাথে। গাযযায় এই বর্বরতা ঘটানো হচ্ছে সারা বিশ্বের চোখের সামনে। এই নিষ্ঠুরতা দখলদারদের হাত থেকে নিজ ভূমি মুক্ত করার লক্ষ্যে পরিচালিত ৭ অক্টোবরের হামলার জবাবি নয়, এটা শুধুই গাজাকে দখল করে পুরো ফিলিস্তিনকে অবৈধ ইসরায়েল রাষ্ট্রে পরিণত করার চক্রান্তের বহিঃপ্রকাশ।
‘সন্ত্রাসী’ তকমার অপবাদের মোকাবেলায় আমরা সবাই হামাসের সাথে। দখলদারিত্ব প্রতিরোধের নীতিগত অধিকার এবং মাতৃভূমি মুক্ত করার সংগ্রামে আমরা সবাই হামাসের সাথে। এই সংগ্রাম সম্পূর্ণ আন্তর্জাতিক নিয়ম ও জাতিসংঘ কর্তৃক স্বীকৃত সনদের অনুগামী। এ লড়াইয়ে অংশগ্রহণকারী ফিলিস্তিনি সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো যে নিয়মসিদ্ধ, প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা বাহিনী, তাতে কোন সন্দেহ নেই। তাদেরকে কোনভাবেই সন্ত্রাসী বলা যায় না এবং আইএসের সাথে মিলানো যায় না। তাদেরকে সন্ত্রাসী বলার পেছনে পশ্চিমা মিডিয়ার একমাত্র উদ্দেশ্য হলো, এই মুক্তিযুদ্ধকে প্রশ্নবিদ্ধ করা এবং মুক্তিবাহিনির সশস্ত্রতাকে নিশ্চিহ্ন করে পুরো ফিলিস্তিনকে ইসরায়েলে পরিণত করার বৈধতা তৈরি করা। অথচ বাস্তবতা হলো, সন্ত্রাস মূলত জায়োনিস্টদেরই চরিত্রগত অংশ, মজলুম ফিলিস্তিনিদেরকে যা ভোগাচ্ছে যুগের পর যুগ।
ফিলিস্তিনের জনগণকে বিশ্বের সামনে অপমান করা হচ্ছে। তাদের মানবাধিকার বলতে কিছু নেই যেন। বিশ্বের অন্যান্য দেশ ও ভূখণ্ডের অধিবাসীরা তাদের দেশে নিরাপদে, নিশ্চিন্তে জীবন যাপন করতে পারে। তাদের কোন শরণার্থী হওয়া বা বাস্তুচ্যুত হওয়ার আশংকা নেই। তাদের খাবার, ওষুধ, পোশাক, বাসস্থান, শিক্ষা, কাগজ কলম ইত্যাদি মানবিক মৌলিক অধিকারের জন্য আন্তর্জাতিক সেবা সংস্থা ও এনজিওদের দ্বারে দ্বারে ঘুরতে হয় না। অথচ ফিলিস্তিনিদের নূন্যতম অধিকার কেড়ে নিয়ে তাদের জীবনকে দু:সহ করে তোলা হয়েছে। তাদের সমস্যার সমাধান না করে বরং আন্তর্জাতিকভাবে আইন করে দখলদারিত্বের বৈধতা দেওয়া হয়েছে। দখলদার ইসরায়েলের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিকিকরণ করা হচ্ছে। ফিলিস্তিনি জনগণের উপর এমন যাবতীয় জুলুম ও প্রহসনের ষড়যন্ত্রকে কঠোরভাবে নাকচ করে দেওয়া এবং নায্য অধিকার আদায়ের লড়াইয়ে আমরা সবাই হামাসের সাথে। হামাসের সমর্থনে আরব ও মুসলিম দেশগুলোতে চলমান বিক্ষোভ মিছিলগুলো ফিলিস্তিনি জনগণ এবং তাদের প্রতিরোধ আন্দোলনের সাথে একাত্মতা প্রকাশ করছে। এমনিভাবে জায়নবাদের বিরুদ্ধে প্রচণ্ড শক্তি হয়েও আবির্ভূত হয়েছে। বর্বর দখলদারদের সাথে তাদের কিছু শাসকদের সম্পর্ক স্থাপন বা স্বাভাবিকিকরণের বিরুদ্ধে এটি পরিষ্কার হুঁশিয়ারি।

জায়নবাদী সন্ত্রাসীদের ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ড ও ফিলিস্তিনিদের রক্ত ঝরানোর জুলুমের সামনে আত্মসমর্পণের অস্বীকৃতি জানাতে আমরা সবাই হামাসের সাথে। দখলদাররা তাদের দখলদারিত্বকে মেনে নেওয়ার বিনিময়ে ফিলিস্তিনিদেরকে শান্তির বাণী শোনায়। জনগণের উন্নতি, অগ্রগতির স্বপ্ন দেখায়। কিন্তু বারবার গণহত্যার মাধ্যমে তাদের আসল চেহারা তো আগেই দেখা হয়ে গেছে আমাদের। তাদের মিষ্টি মধুর কথার উদ্দেশ্যও আমাদের জানা।
সেপ্টেম্বর মাসে জায়নবাদি প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু জাতিসংঘে প্রদত্ত তার ভাষণে নতুন মধ্যপ্রাচ্যের ম্যাপ তুলে ধরেছেন। যেখানে ফিলিস্তিন বলতে কোন দেশই ছিলো না। পশ্চিম তীর, আল কুদস এবং গাজাসহ ফিলিস্তিনের সম্পূর্ণ ভূমিকে ইসরায়েল বলে দেখানো হয়েছে। ইসলামের পবিত্র ভূমি ও স্থাপনার সাথে সাথে পুরো ফিলিস্তিনকে অবৈধ ইসরায়েলি রাষ্ট্রে পরিণত করার নীলনকশা ধূলিস্যাৎ করার লড়াইয়ে আমরা সবাই হামাসের সাথে।
ফিলিস্তিন ইস্যুতে আমেরিকাসহ পশ্চিমা দেশগুলোর বানানো দ্বিচারিতামূলক আন্তর্জাতিক নীতির প্রত্যাখ্যানের লড়াইয়ে আমরা সবাই হামাসের সাথে। ফিলিস্তিনের মানুষদেরকে দুনিয়ার কোন প্রাণী হিসেবেও যেন গণ্য করা হয় না তাদের নীতিতে। ইউরোপ, আমেরিকার এই দ্বিচারিতার নীতিই দখলদার সন্ত্রাসীদেরকে ফিলিস্তিনে যাবতীয় নৃশংসতার বৈধতা দিয়ে রেখেছে। এই জঘণ্য নীতিই মাতৃভূমি উদ্ধারে মুক্তিকামী ফিলিস্তিনিদের যে কোন ধরনের পদক্ষেপ ও সশস্ত্রতার নিন্দা করে। মজলুম ফিলিস্তিনিদের উপর দখলদারদের অত্যাচারের প্রশ্নে তারা মুখে তালা মেরে রাখে, কিন্তু দখলদার ও অবৈধ ইসরায়েলীদের বিরুদ্ধে কিছু করা হলেই তারা সরব হয়ে ওঠে।
জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে অবৈধ ইসরায়েলের পক্ষে আমেরিকা ও পশ্চিমাদের একতরফা অবস্থানের বিরোধিতার লড়াইয়ে আমরা সবাই হামাসের সাথে। তাদের ভেটোর কারণে নিরাপত্তা পরিষদে দখলদারদের বিরুদ্ধে যে কোন ধরণের নিন্দা প্রস্তাব পাশ হতে পারে না। যেরকমভাবে ফিলিস্তিনের স্বাধীকার সংক্রান্ত যে কোন রেজুলেশনও বাস্তবতার মুখ দেখে না। রুশ সেনাবাহিনীর আক্রমণে ইউক্রেনের জনগণ যে ধ্বংসলীলার মুখোমুখি হয়েছে, জায়োনিস্ট দখলদারদের হাতে ফিলিস্তিনের জনগণ তার মুখোমুখি হয়েছে হাজারগুণ বেশি। এই বাস্তবতা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমারা অস্বীকার করতে পারবে না। কিন্তু ফিলিস্তিনিদের অধিকার ও তাদের উপর চলমান জুলুমের ক্ষেত্রে পশ্চিমাদের ভিন্ন অবস্থান কেন? তারা যেরকম ইউক্রেনের পাশে দাঁড়িয়েছে, ফিলিস্তিনের পাশেও তারা দাঁড়াচ্ছে না কেন?
আল আকসা মসজিদ মুসলিমদের ধর্মের অংশ। এর উপর ইহুদীবাদের থাবায় সারা মুসলিম জাহান উদ্বিগ্ন। ইহুদীবাদ কর্তৃক আল আকসাকে ধ্বংস করে এর সামনে তাদের কথিত মন্দির নির্মাণের হীন প্রচেষ্টার মোকাবেলায় আমরা সবাই হামাসের সাথে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমাদের সার্বিক সমর্থন ও সম্মতিতে গাযযায় চলমান জায়োনিস্ট নির্মমতার বিরুদ্ধে আমরা সবাই হামাসের সাথে। গাযযাহ উপত্যকায় ফিলিস্তিনিদের সশস্ত্র প্রতিরোধের নায্যতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে পশ্চিমাদের ষড়যন্ত্রের মুখোশ উন্মোচনে আমরা সবাই হামাসের সাথে। অবৈধ ইসরায়েলের বিরুদ্ধে যে কোন আঞ্চলিক হুমকি দেখা দিলেই পশ্চিমাদের তার পাশে এসে দাঁড়ানো, বিমানবাহী রণতরী, যুদ্ধজাহাজ হাজির করা, সামরিক কার্গো বিমানে করে সাহায্য পাঠানো, দখলদার সন্ত্রাসী কর্তৃক বর্বরতা, মানবাধিকার ও আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন, যুদ্ধাপরাধ ঘটানোর সাথে বারবার নিজেদের সমর্থন নিশ্চিত করা আমরা কখনো ভুলবো না। আরব ও মুসলিম বিশ্বের জনগণ ভুলবে না। দুনিয়াবাসী ভুলবে না।
এই ঔপনিবেশিক অন্যায় আগ্রাসনের মুখে সীমাহীন ত্যাগ স্বীকার করেও আমরা দৃঢ়তা, অটলতা, অবিচলতায় হামাসের সাথে আছি। আমরা আর কিছু জানি না। এরপর হয়তো আল্লাহ পাক অবশ্যই কিছু করবেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *